তারাবির নামাজে এই ভুলে বিপুল সওয়াব হারাবেন না: সঠিক নিয়ম জানুন

রমজানে তারাবির নামাজে বিতর ও তাহাজ্জুদ নিয়ে একটি সাধারণ ভুলে সওয়াব কমে যেতে পারে। ইমামের সাথে নামাজ শেষ করার গুরুত্ব ও সঠিক পদ্ধতি হাদিসের আলোকে জানুন
তারাবির নামাজে যেই ভুলের কারণে বিপুল পরিমাণ সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়ে যাই আমরা

তারাবির নামাজে যেই ভুলের কারণে বিপুল পরিমাণ সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়ে যাই আমরা

তারাবির নামাজ পড়তে গিয়ে, আমাদের অনেকেই এমন একটা ভুল করি, যেই ভুলের কারণে বিপুল পরিমাণ সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়ে যাই আমরা। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ রমজান মাসে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন; যেটা নিঃসন্দেহে খুবই ভালো কাজ। ফলে তাহাজ্জুদগুজার ভাইবোনদের কেউ কেউ মনে করেন, যেহেতু বিতরের নামাজকে রাতের সর্বশেষ নামাজ হিসেবে আদায় করতে বলা হয়েছে হাদিসে, [১] সেহেতু ইমামের সাথে বিতর না পড়ে পরবর্তীতে বিতরের নামাজ একাকী পড়ে নেওয়াই ভালো হবে।

কিন্তু মুশকিল হলো, অন্য হাদিসে এসেছে, তারাবির নামাজ প্রসঙ্গে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি ইমামের প্রস্থান করা পর্যন্ত তাঁর সাথে কিয়াম (রাতের নামাজ আদায়) করে, আল্লাহ তার জন্য সম্পূর্ণ রাত কিয়াম করার সওয়াব লিপিবদ্ধ করেন।” [২] অর্থাৎ ইমাম রাতের নামাজ শেষ না করা পর্যন্ত, যে ব্যক্তি তাঁর সাথে নামাজ পড়ে, সেই ব্যক্তির জন্য পুরো রাত নামাজ পড়ার সওয়াব লেখা হয়।

এই হাদিস অনুযায়ী সালাফদের যুগের মহামতি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ২৪১ হি.) কীভাবে আমল করতেন, তার বিবরণ দিয়েছেন ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ২৭৫ হি.)। ইমাম আবু দাউদ বলেছেন, “আহমাদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, যেসময় আমি (তাঁদের) কথোপকথন শুনছিলাম, ‘ইমাম (একটানা) তিন রাকাত বিতর পড়েন। আমি কি তাঁর সাথে বিতর পড়ব, না জামাত থেকে প্রস্থান করে একাকী বিতর পড়ব?’ আহমাদ বললেন, ‘তুমি তাঁর (ইমামের) সাথে বিতর পড়বে।’ জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কিন্তু লোকেরা কুনুতের মধ্যে শোরগোল করে!’ তিনি প্রত্যুক্তি করলেন, ‘তুমি ইমামের সাথেই বিতর পড়বে।’... আহমাদ জনসাধারণের সাথেই রাতের সালাত আদায় করতেন, এমনকি তাদের সাথেই বিতর পড়তেন। ইমাম নামাজ থেকে প্রস্থান না করা পর্যন্ত তিনি নামাজ থেকে প্রস্থান করতেন না। আমি সম্পূর্ণ রমজান তাঁকে তাঁর ইমামের সাথেই বিতর আদায় করতে দেখেছি। তবে আমার ধারণা, একটি রাত বাদে (এক রাতে আমি দেখার সুযোগ পাইনি), যেই রাতে আমি উপস্থিত ছিলাম না।” [৩]

আমরা জানি, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “এক রাতে দুবার বিতর নেই।” [৪] সুতরাং তাহাজ্জুদ আদায়কারীর জন্য শেষরাতে পুনরায় বিতর আদায় করা সমীচীন নয়। তাহলে তিনি ইমামের সাথে তারাবির নামাজ পড়ার সময় বিতর আদায় করবেন কীভাবে, এ মর্মে দুটো প্রসিদ্ধ মত রয়েছে আমাদের ফুকাহাদের মধ্যে।

প্রথম মত : ইমামের সাথে তারাবি পড়ার পরে যারা তাহাজ্জুদ পড়তে চান, তাঁরা ইমামের সাথে বিতরের নামাজে শরিক হবেন, সেটাকে ‘জোড় নামাজ’ হিসেবে পড়ার নিয়তে। এরপর ইমাম যখন দুইদিকে সালাম ফেরাবেন, তখন (ইমামের দুইদিকে সালাম ফেরানোর পর) তিনি সালাম না ফিরিয়ে উঠে যাবেন এবং একাকী এক রাকাত পড়ে সালাম ফেরাবেন। এর ফলে বিতর (বেজোড়) নামাজ জোড় হয়ে যাবে। পরবর্তীতে তিনি তাহাজ্জুদ আদায় করার পর সর্বশেষ নামাজ হিসেবে বিতর পড়বেন। ইমাম আহমাদ স্পষ্টভাবে এই মত ব্যক্ত করেছেন। [৫] এটা হাম্বালি মাজহাবের অফিসিয়াল মত এবং হাম্বালি মাজহাবের অধিকাংশ ফাকিহ এই মত পোষণ করেছেন। [৬] একদল মালিকি বিদ্বানও এই মত পোষণ করেছেন, [৭] এবং একদল শাফিয়ি ফাকিহও এই মত ব্যক্ত করেছেন। [৮]

দ্বিতীয় মত : তারাবির পরে যারা তাহাজ্জুদ পড়তে চান, তাঁরা ইমামের সাথেই বিতর আদায় করে নেবেন। পরবর্তীতে তাঁরা তাহাজ্জুদ পড়বেন, কিন্তু পুনরায় বিতর পড়বেন না। কেননা বিতরের পরেও নফল নামাজ পড়া যায়; যা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও কাজ থেকে সুসাব্যস্ত হয়েছে। যেমন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি শেষরাতে কিয়াম (তাহাজ্জুদ) করার জন্য উঠতে না পারার আশঙ্কা করে, সে যেন রাতের প্রথমভাগেই বিতর আদায় করে নেয়। আর যে ব্যক্তি শেষরাতে কিয়াম (তাহাজ্জুদ) করার জন্য উঠতে পারার আশা রাখে, সে যেন শেষরাতেই বিতর আদায় করে।” [৯] আবার বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের পরে দুই রাকাত নামাজ পড়েছেন। [১০]

সাইয়্যিদুনা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিয়মিত আমল ছিল—তিনি রাতে ঘুমানোর আগে বিতর পড়তেন। অথচ পরবর্তীতে তিনি তাহাজ্জুদ পড়তেন, কিন্তু পুনরায় বিতর পড়তেন না। [১১] এসব হাদিসের ভিত্তিতে দ্বিতীয় মত ব্যক্ত করেছেন একদল ফাকিহ। এটা হাম্বালি মাজহাবের আরেকটি অভিমত। [১২]

শাইখ ইবনু বাজ রাহিমাহুল্লাহকে (মৃ. ১৪২০ হি.) উক্ত দুই মতের আমল এবং বিলকুল ইমামের সাথে বিতর না পড়ার আমল প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “প্রশ্নকারী যেই আমলগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন, সেসবের সবই বৈধ। আলহামদুলিল্লাহ, এক্ষেত্রে প্রশস্ততা রয়েছে। কিন্তু ইমামের নামাজ শেষ না করা অবধি যে ব্যক্তি তাঁর সাথে থাকে (তাঁর সাথে শেষ পর্যন্ত নামাজ পড়ে), সে ব্যক্তি সর্বোত্তম আমলের মর্যাদা হাসিল করে এবং সে তার মতো আমলকারী হয়ে যায়, যে কিনা সারারাত ধরে নামাজ পড়েছে।” [১৩]

তবে আমাদের আল্লাহওয়ালা উলামাদের মানহাজ অনুসরণ করে আমরা পরামর্শ দিচ্ছি, ফেতনার আশঙ্কা থাকলে প্রথম মতের আমল থেকে বিরত থাকবেন। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সর্বোত্তম আমলের তৌফিক দিন। আমিন।

❏ পাদটীকা :

  1. [১]. সহিহুল বুখারি, হা. ৪৭২।
  2. [২]. আবু দাউদ, হা. ১৩৭৫; তিরমিজি, হা. ৮০৬; নাসায়ি, হা. ১৩৬৪; ইবনু মাজাহ, হা. ১৩২৭; বর্ণনার মান : সহিহ।
  3. [৩]. আবু দাউদ সুলাইমান বিন আশআস আস-সিজিস্তানি, মাসায়িলুল ইমাম আহমাদ রিওয়াইয়াতু আবি দাউদ আস-সিজিস্তানি, তাহকিক : আবু মুয়াজ তারিক আওয়্যাদাল্লাহ (মিশর : মাকতাবাতু ইবনি তাইমিয়া, ১ম প্রকাশ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), পৃ. ৯০।
  4. [৪]. আবু দাউদ, হা. ১৪৩৯; বর্ণনার মান : সহিহ।
  5. [৫]. মুওয়াফফাকুদ্দিন আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ ইবনু কুদামা আল-মাকদিসি, আল-মুগনি, তাহকিক : আব্দুল্লাহ আত-তুর্কি ও আব্দুল ফাত্তাহ মুহাম্মাদ (রিয়াদ : দারু আলামিল ফাওয়ায়িদ, ৩য় প্রকাশ, ১৪১৭ হি./১৯৯৭ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ৫৯৮-৫৯৯।
  6. [৬]. আবুল হাসান আলি বিন সুলাইমান আল-মার্দাওয়ি, আল-ইনসাফ ফি মারিফাতির রাজিহি মিনাল খিলাফ, তাহকিক : আব্দুল্লাহ আত-তুর্কি ও আব্দুল ফাত্তাহ মুহাম্মাদ (কায়রো : দারু হাজার, ১ম প্রকাশ, ১৪১৫ হি./১৯৯৫ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ১৬৯-১৭০।
  7. [৭]. আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ ইবনু রুশদ আল-কুরতুবি, আল-বায়ানু ওয়াত তাহসিলু ওয়াশ শারহু ওয়াত তাওদিহু ওয়াত তালিলু লি মাসায়িলিল মুস্তাখরাজা, তাহকিক : মুহাম্মাদ হাজ্জি ও তাঁর সঙ্গীবর্গ (বৈরুত : দারুল গরবিল ইসলামি, ২য় প্রকাশ, ১৪০৮ হি./১৯৮৮ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ২৯০-২৯১।
  8. [৮]. আহমাদ বিন মুহাম্মাদ ইবনু হাজার আল-হাইতামি, তুহফাতুল মুহতাজ ফি শারহিল মিনহাজ (মিশর : আল-মাকতাবাতুত তিজারিয়্যাতুল কুবরা, প্রকাশের ক্রমধারাবিহীন, ১৩৫৭ হি./১৯৮৩ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ২২৯-২৩০।
  9. [৯]. সহিহ মুসলিম, হা. ৭৫৫।
  10. [১০]. সহিহ মুসলিম, হা. ৭৩৮।
  11. [১১]. আবু দাউদ, হা. ১৪৩৪, বর্ণনার মান : সহিহ; আবু উমার ইউসুফ বিন আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দিল বার্র আল-কুরতুবি, আল-ইস্তিজকার, তাহকিক : সালিম মুহাম্মাদ আতা ও মুহাম্মাদ আলি মুআওয়্যাদ (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, ১ম প্রকাশ, ১৪২১ হি./২০০০ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ১১৬।
  12. [১২]. শামসুদ্দিন মুহাম্মাদ ইবনু মুফলিহ আল-মাকদিসি, আল-ফুরু, তাহকিক : আব্দুল্লাহ আত-তুর্কি (বৈরুত ও রিয়াদ : মুআসসাসাতুর রিসালা ও দারুল মুআয়্যাদ, ১ম প্রকাশ, ১৪২৪ হি./২০০৩ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ৩৭৬; আল-মার্দাওয়ি, আল-ইনসাফ, খ. ৪, পৃ. ১৬৯-১৭০।
  13. [১৩]. আব্দুল আজিজ বিন আব্দুল্লাহ ইবনু বাজ, মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাতুম মুতানাওয়্যাআ, সংকলন ও তত্ত্বাবধান : মুহাম্মাদ বিন সাদ আশ-শুওয়াইয়ির (সৌদি আরব : রিআসাতু ইদারাতিল বুহুসিল ইলমিয়্যা ওয়াল ইফতা, তাবি), খ. ৩০, পৃ. ২৮।

Post a Comment

আপনার কমেন্ট রিভিউ করে দেখা হবে! প্রয়োজনে SalafiArchive কর্তৃপক্ষ আপনার কমেন্ট রিমুভ করার অধিকার রাখে।

Join the conversation

Disqus shortname is missing. Consider reporting about this message to the admin of this blog. It seems you are the admin of this blog, add disqus shortname through Theme HTML editor to enable Disqus comments.

Join the conversation